
মিরর ডেস্ক : সূর্যমুখী (Sunflower) এর বৈজ্ঞানিক নাম Hellianthus annus যা মূলত তেল জাতীয় ফসল। সূর্যমুখীর বীজে শতকরা ৪০-৪৫ ভাগ উপকারী লিনোলিক এসিড রয়েছে এবং ক্ষতিকর কোনো ইরোসিক এসিড থাকে না। হৃদরোগীদের জন্য সূর্যমুখীর তেল খুবই উপকারী।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সূর্যমুখীর ব্যাপক চাষ হয়। ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশের চাষিরা এর আবাদ শুরু করেন। বর্তমানে রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়া, নাটোর, পাবনা, দিনাজপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলাগুলোতে এর ব্যাপক চাষ হচ্ছে।
সূর্যমুখীর চাষ সারা বছর করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ মাসে (মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য-ডিসেম্বর) চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রী সে. এর নিচে হলে ১০-১২ দিন পরে বীজ বপন করতে হয়। খরিপ-১ মৌসুমে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ (মধ্য-এপ্রিল থেকে মধ্য-মে) মাসেও এর চাষ করা যায়।
জমি তৈরি : সূর্যমুখীর জমি গভীরভাবে চাষ দিতে হয়। জমি ৪-৫ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
জাত পরিচিতি : এ পর্যন্ত বারি কর্তৃক ২টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যথা (১) কিরণী (ডিএস-১) এবং বারি সুর্যমুখী-২।
কিরণী (ডিএস-১) : ১৯৯২ সালে জাতটির অনুমোদন দেয়া হয়। বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। জাতটির কান্ডের ব্যাস ১.৫-২.০ সে.মি.। পরিপক্ক পুষ্পমঞ্জুরী বা শাখার ব্যাস ১২-১৫ সে.মি.। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪০০-৬০০। বীজের রং কালো। ১০০০ বীজের ওজন ৬৮-৭২ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৪ ভাগ। জাতটি মোটামুটি অলটারনারিয়া বৱাইট রোগ সহনশীল। জীবনকাল ৯০-১১০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ১.৬ হতে ১.৮ টন।
বারি সূর্যমুখী-২ : গাছের কান্ডের ব্যাস ২.০-২.৪ সে.মি.। পরিপক্ক পুষ্পমঞ্জুরী বা শাখার ব্যাস ১৫-১৮ সে.মি.। বীজের রং কালো। ১০০০ বীজের ওজন ৬৫-৭০ গ্রাম। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪৫০-৬৫০। তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৪ ভাগ। জীবনকাল রবি মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ৯০-৯৫ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন রবি মৌসুমে ২.০ হতে ২.৩ টন এবং খরিপ মৌসুমে ১.৫ হতে ১.৮ টন।
বপন পদ্ধতি ও বীজের হার : সূর্যমুখীর বীজ সারিতে বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সে.মি. এবং সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৫ সে.মি. রাখতে হয়। এভাবে বীজ বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮-১০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
সার প্রয়োগ:
সারের নাম | সারের পরিমাণ ( হেক্টর প্রতি ) |
ইউরিয়া | ১৮০-২০০ কেজি |
টিএসপি | ১৫০-২০০ কেজি |
এমপি | ১২০-১৫০ কেজি |
জিপসাম | ১২০-১৭০ |
জিংক সালফেট | ৮-১০ কেজি |
বরিক এসিড | ১০-১২ কেজি |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট | ৮০-১০০ কেজি |
ইউরিয়া সারের অর্ধেক এবং বাকি সব সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া দুই ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় ভাগ ৪০-৪৫ দিন পর বা ফুল ফোটার আগে প্রয়োগ করতে হবে।
রোগবালাই ও প্রতিকার :
সূর্যমুখীর পাতা ঝলসানো রোগ : লটারনারিয়া হেলিয়াস্থি নামক ছত্রাকের আক্রমণে সূর্যমুখীর এ রোগটি হয়ে থাকে। প্রথমে পাতায় ধূসর বা গাঢ় বাদামি বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে। পরে দাগ মিশে গিয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে। অবশেষে সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায়।
প্রতিকার : প্রতিকারের জন্য রোগ সহনশীল কিরণী জাত চাষ করতে হবে। এই রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রোভরাল/ ইভারোল ৫০ ডব্লিউপি ২ গ্রাম/লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। ফসল কাটার পর গাছের পরিত্যক্ত অংশ নষ্ট করলে বা পুড়িয়ে ফেললে এ রোগের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।
সূর্যমূখীর শেকড় পচা রোগ : সাধারণত স্কেলেরোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত গাছের গোড়া সাদা তুলার মতো ছত্রাকের মাইসেলিয়াম এবং গোলাকার দানার মতো স্কেলেরোশিয়াম দেখা যায়। প্রথমে গাছ কিছুটা নেতিয়ে পড়ে। কয়েক দিনের মধ্যে সমস্ত গাছ ঢলে পড়ে এবং শুকিয়ে মারা যায়।
প্রতিকার : এই রোগের প্রতিকার হিসেবে প্রোভেক্স/ অটোস্টিন-২০০ দিয়ে বীজ শোধনের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার রোধ করা যায়। সাধারণত জমি পানি সিক্ত থাকলে এ ছত্রাক বাঁচতে পারে না। সুতরাং রোগ আক্রমণের পর জমিতে প্লাবন সেচ দিয়ে এ রোগের প্রকোপ কমানো যায়। শস্য পর্যায় অবলম্বন করেও রোগের বিস্তার রোধ করা যায়।
পোকামাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা :
বিছা পোকার লক্ষণস : ছোট অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে থাকে। কীড়া বা বিছা হলুদ রঙের এবং গায়ে কাঁটা থাকে। এরা সাধারণত গাছের পাতায় আক্রমণ করে। এ পোকার কীড়া দলবদ্ধভাবে থেকে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে পাতলা সাদা পর্দার মতো করে ফেলে। উষ্ণ আবহাওয়াতে এই পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা : পোকা দেখার সাথে সাথে গাছ থেকে পোকাসহ পাতা সংগ্রহ করে পোকা মেরে ফেলতে হবে। সেচ নালায় কেরোসিন মিশ্রিত পানি থাকলে কীড়া পানিতে পড়ে মারা যায়। আক্রমণ বেশি হলে নাইট্রো (সাইপারমেথ্রিন+ ক্লোরোপাইরিপস) ২০ ইসি ২ মিলি/লিটার অথবা ডায়াজিনন-৬০ ইসি ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষতে ১০ দিন পর পর ২ বার বিকালে জমিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ বা স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ : বপন থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত ৯০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করতে হয়।