
ঢাকা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছয় দফা না আট দফা‑ এটা নিয়ে যখন চরম বিতর্ক, সেই ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং আমাদের বাসায় হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগেরও অনেক সিনিয়র নেতা চলে গেছেন আট দফার পক্ষে। কারণ, পাকিস্তান থেকে নেতারা এসেছেন আট দফার পক্ষ নিয়ে। কিন্তু আট দফা ছিল একটা শুভঙ্করের ফাঁকি। এটা তাদের মতো শিক্ষিত অনেকেই হয়তো ধরতে পারেননি। কিন্তু আমার মায়ের কাছে সেটা স্পষ্ট ছিল। সেখানে আমার মায়ের স্পষ্ট কথা ছিল, ছয় দফার একটা দাঁড়ি কমা সেমিকোলনও বদলাবে না। যেটা বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন সেটাই হতে হবে। সেই সিদ্ধান্তটাই ওয়ার্কিং কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল।
রবিবার (৮ আগস্ট) ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন’ ও ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২১ প্রদান’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অনেক নেতা, বড় আইনজীবী, বড় সাংবাদিক‑ তাদের অনেকেই প্যারোলে যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছিলেন। আমার মা সেখানে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদি এই সিদ্ধান্তটা সঠিকভাবে না নিতেন আর খবরটা আমার বাবার কাছে না পৌঁছাতেন, তাহলে বাংলাদেশ কোনদিনও স্বাধীন হতো না।
তিনি বলেন, এরপরে এলো ৭ই মার্চের ভাষণ। সেই ভাষণের সময়েও অনেকের অনেক কথা ছিল। কেউ কেউ এত উৎসাহিত বা উত্তেজিত যে এই মুহূর্তেই ঘোষণা দিতে হবে। তাহলে তো জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো ঘটনা ঘটে যেতো। ওখান থেকে একটি মানুষও জীবিত ফিরে যেতে পারতো না। আর কোনও দিন যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করা যেতো না।
সরকার প্রধান বলেন, সেখানে আমার মায়ের যে কথা, মায়ের যে পরামর্শ, সেটাই কিন্তু বাংলাদেশের ভাগ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যার জন্য আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করি। এরকম আরও বহু সময়ে আমি দেখেছি। সব থেকে বড় কথা হলো, নিজের জীবনটাকে তিনি সব সময় খুব সাদাসিধা রেখেছেন।
তিনি বলেন, আমার আব্বা যখন প্রধানমন্ত্রী, মা’র কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের মধ্যে তাদের যদি বিলাসিতা হয়, তাহলে অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে, নজর খারাপ হয়ে যাবে। ওই বত্রিশ নাম্বারের বাড়ি ছেড়ে তিনি কখনও আসেননি। এসেছেন, হয়তো ঘুরে দেখে গেছেন। কিন্তু ওইখানে বসবাস করার কথা কখনও চিন্তাও করেননি। আমার মাকে আমি সব সময় একই রকম দেখেছি। কখনও কোন ব্যাপারে বেশি বিলাসিতা পছন্দ করতেন না।
শেখ হাসিনা বলেন, দল চালাতে গেলে বা দলের নেতাকর্মীরা যখন জেলে, তাদের পরিবারের ভরণপোষণ বা তাদের বাজারের টাকাটা পর্যন্ত আমার মা নিজে দিয়েছেন। যার জন্য নিজের গয়নাগাটি বা আমাদের বাড়ির অনেক জিনিস তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনদিন বলেননি যে আমার এটা নাই বা এ নিয়ে হা-হুতাশ করেননি। আমি আমার মার কাছে কখনও হা-হুতাশ শুনিনি। কোনও দিন তিনি মুখ ফুটে বলতে না যে এটা নাই। বরং আমাদের বাড়িতে এটা ছিল– কেউ নাই বলতে পারবে না। কি লাগবে এটা বলা লাগবে। নাই বলতে পারবে না। এভাবে তিনি কিন্তু একদিকে সংসার সামলিয়েছেন, অপরদিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও। সে সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সময়ে যাতে হয় তার ব্যবস্থা করেছেন।
তিনি বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম এই দলকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ সব সময় সঠিক পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যাতে চলতে পারে সেই দিকনির্দেশনা তিনি দিয়েছেন। সব তথ্য আমার বাবার কাছে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া এবং তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এসে এই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো এই কাজগুলোও তিনি গোপনে করেছেন। এইভাবে তিনি তার জীবনটাকে উৎসর্গ করেছেন, আমার বাবা যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেন সেই আদর্শের কাছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিন্তু কখনও রাজনৈতিক নেতা হতে হবে বা রাজনীতি করে কিছু পেতে হবে সেই চিন্তা তাঁর ছিল না। কোনও সম্পদের প্রতিও তার কোনও আগ্রহ ছিল না। নিজের যা ছিল সেটুকুই যথেষ্ট মনে করতেন। এভাবেই তিনি নিজের জীবন গড়ে তুলেছিলেন। আর সবশেষে আপনারা দেখেছেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। মানুষ যখন একটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন তাঁর মনে সব থেকে আগে আসে নিজের জীবনটাকে বাঁচানোর এবং নিজের জীবনটাকে ভিক্ষা চাওয়ার। আমার মা খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চান নাই।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি (বঙ্গমাতা) নিজের জীবন দিয়ে গেছেন। আমার আব্বাকে যখন হত্যা করলো, সেটা যখন তিনি দেখলেন, তখনই সোজা খুনিদের বললেন, তোমরা ওনাকে মেরেছো আমাকেও মেরে ফেলো। তারা বলেছিল, আপনি আমাদের সাথে চলেন। তিনি বলেছিলেন, তোমাদের সাথে আমি যাবো না। তোমরা এখানেই আমাকে খুন করো।
তিনি বলেন, ঘাতকদের বন্দুক গর্জে উঠেছিল। আর সেখানেই আমার মাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। আমাদের পরিবারে তো কেউ বেঁচে ছিল না। আমরা দুই বোন বিদেশে ছিলাম। কতটা সাহস একটা মানুষের মনে থাকলে এই মানুষটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন ভিক্ষা না নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট আমি তো আপনজন সবাইকে হারিয়েছি। শুধু একটাই প্রশ্ন সব সময়, কেন এই হত্যাকাণ্ড। কী অপরাধ ছিল আমার বাবার? আমার মায়ের? আমার ভাইদের? যারা নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করলেন। সারা জীবনের সুখ-শান্তি বিলিয়ে দিলেন একটা জাতির স্বাধীনতার জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। তাঁকে সেই বাঙালিই খুন করলো, হত্যা করলো। কেন?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের অবহেলিত নারী সমাজ একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে। আমি মনে করি, আমার মায়ের জীবনের এই কাহিনী শুনলে অনেকেই হয়তো অনুপ্রেরণা পাবে, শক্তি, সাহস পাবে। দেশের জন্য, জাতির মঙ্গলের জন্য কাজ করবে।