
অর্থনীতি রিপোর্ট : দেশের কতগুলো কম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ করেছে তার সঠিক কোনো তথ্য নেই, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করছে—এমন কম্পানির সংখ্যা এখন ১৭। এর মধ্যে পাঁচটিরই অনুমতি মিলেছে চলতি আগস্ট মাসেই। সব মিলিয়ে প্রায় ৫শ’ ১১ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে কম্পানিগুলো। এর বিপরীতে ৩শ’ ৪১ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গত ১৯ আগস্ট পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব উদ্যোক্তা বিদেশে বিনিয়োগ করেছেন তাঁদের কেউ কেউ লোকসানে পড়েছেন। কেউ কেউ বিনিয়োগ ফেরতও এনেছেন। আবার কোনো কোনো কম্পানি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুই করতে পারেনি। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশের অভাবেও দেশি কম্পানিগুলো বিদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকছে। এদের মধ্যে কেউ বৈধভাবে অনুমতি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করছে। আবার কেউ অনুমতি না নিয়েই পাচারের টাকায় বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। তাই অর্থপাচার রোধে দেশি কম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে মত দেন তাঁরা।
বিদ্যমান আইনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ উন্মুক্ত নয়। ফলে দেশের কোনো কম্পানি চাইলেই বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শর্ত সাপেক্ষে বিনিয়োগ করতে পারে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ সংশোধন করে আগ্রহী কম্পানিগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অনেকেই অবৈধ পথে টাকা নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে, তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছেই নেই।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ভালো। কাজেই দেশের কম্পানিগুলো বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে তাদের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। তবে যে দেশে বিনিয়োগ করতে চায় সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে কি না। কারণ অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগের নামে টাকা পাচারও করছে।’ আমরা বিদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকছি, কিন্তু দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর জন্য অন্য কারণ দায়ী। এজ অব ডুয়িং বিজনেস, গুড গভর্ন্যান্স ইন্ডিকেটর, কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স—এগুলোর সব কটিতেই আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এখন নিজ দেশের বিনিয়োগকারীরা যদি বিনিয়োগ না করে, তাহলে বিদেশিরাও আগ্রহ দেখাবে না। তারা মনে করে, এখানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই।’ তাহলে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাবে দেশি উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করার দিকে ঝুঁকছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা কিছুটা তো আছেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের যে কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের প্রাধান্য বেশি। কারণ তাদের ডলারে আয় হয়। তিনি আরো বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো লিখিত নীতিমালা এখনো নেই।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সাল থেকে এসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির কাজ করলেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) বিদেশে বিনিয়োগের একটি নীতিমালা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি বিনিয়োগ নীতিমালা ২০২১’ শীর্ষক ওই নীতিমালার খসড়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, মোট রিজার্ভের ৫ শতাংশ বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হবে। রপ্তানিকারকরা তাদের পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের গড় রপ্তানি মূল্যের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত এবং অন্য কম্পানি তাদের সর্বশেষ নিরীক্ষিত ব্যালান্স শিট মোতাবেক নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে কোনো কম্পানির এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হলে এ ব্যাপারে যৌক্তিকতা তুলে ধরে আবেদন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বাংলাদেশি ১৭টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। অনুমোদিত টাকার পরিমাণ প্রায় ছয় কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫শ’ ১০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এদিকে ১৭টি কম্পানির মধ্যে এ মাসেই পাঁচটি কম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কম্পানিগুলো হলো প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রাণ ফুডস লিমিটেড, নাসা গ্রুপের এজে সুপার গার্মেন্ট, এমবিএম গার্মেন্ট, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও রেনাটা লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালে মবিল যমুনা বা এমজেএল বাংলাদেশকে মিয়ানমারে একটি যৌথ মূলধনী কম্পানিতে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে পাঁচ লাখ ১০ হাজার ডলার নিয়ে সেখানে ‘এমজেএল অ্যান্ড একেটি পেট্রোলিয়াম’ নামের একটি কোম্পানি গঠন করে তারা। পরে আরো তিন লাখ ৮৮ হাজার ডলারসহ কম্পানিটিতে মোট আট লাখ ৯৮ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে মবিল যমুনা। তবে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় মবিল যমুনা ২০১৯ সালের জুনে শেয়ার বিক্রি করে ১৩ লাখ ডলার ফেরত এনেছে। এ ছাড়া মবিল যমুনা ২০১৯ সালের মার্চে সিঙ্গাপুরের এমজেএল (এস) পিটিই নামের কম্পানিতে এক লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছিল, তবে পরিচালন ব্যয় বাড়ার কারণে তা লোকসানে পড়েছে।
২০১৪ সালের এপ্রিলে ঔষধ খাতের কম্পানি ইনসেপ্টা এস্তোনিয়ায় আড়াই হাজার ইউরো বিনিয়োগ করে। এই বিনিয়োগের বিপরীতে সেখানে ইনসেপ্টা নরডিক ওইউয়ের ৫০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। তবে এখন সেই শেয়ার দেশটির কমেড বালিটিক ওইউ নামের একটি কম্পানির কাছে দুই হাজার ৬শ’ ১৩ ইউরোতে বিক্রি করে বিনিয়োগ ফেরত আনার অনুমোদন চেয়েছে।
স্কয়ার ফার্মা ২০১৬ সালে কেনিয়ায় এক কোটি ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগের জন্য অনুমোদন পায়। এর বিপরীতে দেশটিতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কেনিয়া ইপিজেড নামের একটি কম্পানি গঠন করে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর এবং গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই ধাপে তারা এক কোটি পাঁচ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছে, তবে এখনো বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়নি।
তৈরি পোশাক খাতের ডিবিএল গ্রুপ ইথিওপিয়ায় ৯৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের জন্য ২০১৫ সালে অনুমোদন নেয়। তিন ধাপে ২০১৮ সালের মধ্যে পুরো টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৮ সালের জুন থেকে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। আকিজ জুট মিলস ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করে। সেখানকার আকিজ রিসোর্সেস এসডিএন বিএইচডি নামের কম্পানিতে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ দুই কোটি ডলার। এই কম্পানি মালয়েশিয়া থেকে আবার তিন কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে। সেই ঋণের সুদ পরিশোধের কারণে লোকসানে চলছে।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস বা বিএসআরএম কেনিয়ায় ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগের জন্য ২০১৬ সালে অনুমোদন নেয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালে শেয়ার মূলধন ও ব্যাংক চার্জ বাবদ ২৭ হাজার ২০০ ডলার সেখানে নিয়ে গেছে। কম্পানির অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন।
স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরে সাড়ে ১০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার বিনিয়োগ করে। তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সামিট পাওয়ার লিমিটেড ও সামিট পাওয়ার অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড ২০২০ সালের ২০ নভেম্বর ভারতে সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ইস্ট গেটওয়ে (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট নামে সাবসিডিয়ারি কম্পানিতে ৯৯ হাজার ৮শ’ রুপি বিনিয়োগের অনুমতি নেয়।
এএসএম মহিউদ্দিন মোমেন আজিম ইন্টারন্যাশনাল নামে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৬ সালে ৭৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে সার্ভিস ফি হিসেবে দুই দফায় ১৫ হাজার ৯০১ ডলার দেশে আনা হয়েছে। ২০১৬ সালে সার্ভিস ইঞ্জিন নামের একটি কম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাড়ে সাত হাজার ডলার বিনিয়োগ করে। প্রতিষ্ঠানটি সেবার ফি হিসেবে এরই মধ্যে তিন দফায় ১৫ হাজার ৯শ’ ১ ডলার দেশে এনেছে। টেকআউট নামের রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কায় টেকআউট লঙ্কা নামে ৫শ’৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি বিনিয়োগের অনুমতি নিয়েছে ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর। এ ছাড়া এসিআই হেলথকেয়ারকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রি থেকে পাওয়া ১০০ ডলার দেশে ফেরত না এনে সেখানে একটি কম্পানি গঠনের জন্য ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর অনুমতি দেওয়া হয়।
এর বাইরে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বিদেশি দুই দেশের কম্পানিতে শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে কারিগরি পরামর্শ ও অন্যান্য সেবার বিপরীতে সৌদি আরবের জুবাইল ফার্মার ৪২ শতাংশ শেয়ার বেক্সিমকো ফার্মা পেয়েছে। এই শেয়ারের ৩০ শতাংশ ২০২০ সালের জুনে দুবাইভিত্তিক কম্পানি আরআর হোল্ডিংসের কাছে বিক্রি করে সমপরিমাণ ১১ লাখ ২৪ হাজার ৭শ’ ৮৫ ডলার দেশে আনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে কারিগরি পরামর্শ ও অন্যান্য সেবার বিপরীতে মালয়েশিয়ার বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ৩০ শতাংশ শেয়ার পেয়েছে বেক্সিমকো। তবে মালয়েশিয়ার বায়োকেয়ার প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এ ছাড়া কম্পানিটির পরিচালন ব্যয়ের কারণে লোকসান হচ্ছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার একটি কম্পানিতে ৬০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে বেক্সিমকো।
জানা গেছে, নতুন অনুমতি পাওয়া নাসা গ্রুপভুক্ত এজে সুপার গার্মেন্ট সৌদি আরবে সিটি অব ড্রিমস ফর ডেটস নামের কম্পানিতে ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০ লাখ ৬২ হাজার ৬শ’ ৬৫ ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারতে পিনাকল ফোর-এস নামের একটি সাবসিডিয়ারি স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে।
সিঙ্গাপুরে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে এমবিএম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এমবিএম গার্মেন্ট লিমিটেড। প্রস্তাবিত কম্পানির নাম এমবিএম সিঙ্গাপুর লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি এক লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এক লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। প্রস্তাবিত সাবসিডিয়ারি কম্পানির নাম হবে ইনসেপ্টা ফার্মা ইউএসএ লিমিটেড। অন্যদিকে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নামে আয়ারল্যান্ডে একটি সাবসিডিয়ারি গঠনের অনুমতি পেয়েছে রেনাটা লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটিতে সাত হাজার ১শ’ ইউরো বিনিয়োগের অনুমোদন মিলেছে।