
অর্থনীতি রির্পোট : গত বছর একেকটি গরুর চামড়া মাত্র ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকায় কিনেছেন মৌসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। বেশিরভাগ এলাকায় ছাগলের চামড়া বিক্রিই হয়নি। এরপর আবার সেই চামড়া আড়তে নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বড় বিপদে পড়েছিলেন। প্রতিটি গরুর চামড়া ১শ’ টাকা, এমনকি ছাগলের চামড়া ১০ টাকায়ও বিক্রি করতে হয়েছিল অনেককে।
ওই সময় চামড়া নিতে আড়তদারদের অনেক অনুরোধ করেন লোকসানে থাকা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত রাগে-দুঃখে কেউ কেউ সড়কের ওপর চামড়া ফেলে বাড়ি ফিরে যান। এসব ঘটনা সারাদেশের বিভিন্ন চামড়া আড়তেই ঘটেছে।
আসন্ন কোরবানি ঈদ নিয়ে চামড়া শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঈদেও এমন পরিস্থিতির শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বরং এবার সেই আশঙ্কা আরও বেশি রয়ে গেছে বলেও মত দিয়েছেন অনেকে।
এর কারণ হিসেবে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চলতি মৌসুমে করোনার কারণে চাহিদা না থাকায় ট্যানারিগুলোতে এখনও ৫শ’ থেকে ৬শ’ কোটি টাকার চামড়া জমে রয়েছে। যদিও রফতানি বাজার কিছুটা বেড়েছে। তারপরও পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে আরও সময় লাগবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘প্রচুর চামড়া আমাদের গুদামে রয়ে গেছে। ২০১৯ সাল থেকে করোনার কারণে চায়নায় একই সময়ে একশ কন্টেইনারের বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছিল। সে চামড়া বিভিন্ন উপায়ে বিক্রির চেষ্টা করা হয়েছে পরে। কিন্তু এর পরপরই ইউরোপের বাজারেও করোনা ছড়িয়ে পড়ে। তখন অনেক চামড়া কম দামে বিক্রি হয়েছে। লোকসান দিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা।’
তিনি বলেন, ‘যদিও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে রফতানির বাজার কিছুটা ভালো। ইউরোপ মার্কেট খুলেছে। বিক্রি ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি।’
আসন্ন ঈদে কি পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘আগামী বছর ভালো যাবে। এবারের ঈদ কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই আসছে। চামড়া সংগ্রহ হবে, কিন্তু বিক্রি না করতে পারলে এত চামড়া কী করব? রফতানি এতটা বাড়েনি এখনও, যত চামড়া এখন ঈদে কেনা দরকার। নিজেদের অবিক্রীত চামড়াই বিক্রি হচ্ছে না।’
এদিকে যারা আড়তে কাঁচা চামড়া কেনেন, তাদের সংগঠনের অভিযোগ ট্যানারি মালিকদের বিরুদ্ধে। ওই সংগঠনের ভাষ্য, বাড়তি চামড়া মজুতের অজুহাতে তারা বাজারে বিপর্যয় তৈরি করছেন।
কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, ‘ট্যানারি বলছে তাদের চামড়া মজুত রয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো তাদের যথেষ্ট বিক্রি রয়েছে, অর্ডার হচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা ২০ হাজার মজুত থাকলে বলে ৮০ হাজার আছে। কারণ কেউ তো দেখতে যায় না। এরা এসব বলে চামড়া কেনার টাকা আটকে রাখেন। বাজার ওঠে না।’
আসন্ন ঈদের পরে চামড়ার বাজার কেমন হবে এ প্রশ্নের জবাবে এ ব্যবসায়ীরাও শঙ্কার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ট্যানারি মালিকরা গত চার বছরের চামড়ার দাম বাবদ ১শ’ ১০ কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন আড়তদারদের কাছে। এ টাকা পরিশোধ করলে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক দামে চামড়া কিনতে পারবেন। বাজার ঠিক হবে।’
এদিকে গত বছর চামড়ার দাম খুব কমিয়ে নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫-৪০ টাকা। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দর ২৮ থেকে ৩২ টাকা। যেখানে তার আগের বছর (২০১৯) এই দাম ছিল ৪৫-৫০ টাকা। অর্থাৎ গত বছর দাম কমানো হয়েছিল তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৯ শতাংশ। এ বছরও দাম বাড়ছে না বলে আভাস দিয়েছে একাধিক সূত্র।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল আজহায় সম্ভাব্য কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি ১৮ লাখ। এর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়া ৭২ লাখ ৫৬ হাজার। গত বছর দাম নির্ধারণের পর তা নিয়ে অসন্তোষ ছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু বাস্তবে ঈদের পরে সেই দামও পায়নি মানুষ। চামড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল বিপত্তি। অনেকে বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিয়েছে। চামড়ার এমন সংকট শুধু গত বছর নয়, ২০১৭ সালের পর থেকেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি সপ্তাহেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বৈঠকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম এবং সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এ বছর দাম নির্ধারণ হবে। ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে নির্ধারণ করতে চাচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় বলছে, চামড়ার দাম ঠিক রাখতে ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়া হয়েছে প্রায় ৩০ বছর পর। যদিও সেটা সীমিত পরিসরে শর্তসাপেক্ষে। গত ১০ জুলাই এক কোটি বর্গফুট চামড়া রফতানির অনুমতি পেয়েছে পাঁচটি ট্যানারি। প্রয়োজনে আরও কাঁচা চামড়া ও ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানি করা হবে। এছাড়া ঈদের দিন থেকে দেশব্যাপী কঠোরভাবে বিষয়গুলো মনিটরিং করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত মনিটরিং টিম। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বছর বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জেলা পর্যায়ে চামড়ার দাম মনিটরিং করবে।
চামড়া রফতানি বেড়েছে
এদিকে চার বছর পর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছর প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে চামড়াজাত পণ্যের রফতানি। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব থাকলেও এর প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ কারণে রফতানি আদেশও বেড়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত অর্থবছর (২০২০-২১) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রফতানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ।
তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ১শ’ ১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১শ’ ১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ আয় আরও বেড়ে হয় ১শ’ ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়াশিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়।
এরপর থেকেই ধস নামে এ খাতের রফতানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১শ’ ৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১শ’ ২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে।
বড় পরিসরে চামড়া রফতানি প্রয়োজন
কয়েক দিন আগে স্বল্প পরিসরে চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়া হয়েছে। চামড়া খাতের দীর্ঘ জটিলতা কাটাতে বড় পরিসরে রফতানি প্রয়োজন বলে মনে করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। গত বছরের চামড়া পরিস্থিতির পরে এ সংস্থাটি ঈদুল আজহায় পশুর কাঁচা চামড়া নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে রফতানির সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করে।
সংস্থাটি বলছে, ঈদে চামড়া নষ্ট হচ্ছে যার বড় কারণ ছিল চামড়া কিনতে অনীহা। এছাড়া দেশের চামড়া প্রক্রিয়াকারী ট্যানারি মালিকেরা চামড়া কেনার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত টাকা ছাড়েননি। এ জন্য তারা ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, চামড়ার ন্যূনতম দাম ঠিক করে রফতানির সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এতে দেশের মানুষ ও খামারিরা উপকৃত হবে। চামড়ার চাহিদা তৈরি হবে।