
মিরর ডেস্ক : কুচিয়া মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছে। কুচিয়া মাছ বাংলাদেশে কুইচ্চা, কুঁইচা, কুঁচে, কুঁচো ইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রজাতির কুচিয়া ( Monopterus cuchia ) প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে আহরণ করে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। আসুন জেনে নেই কুচিয়া মাছের ( Cuchia Fish ) প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল সম্পর্কে-
কুচিয়া মাছের প্রজনন কৌশ : প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুচিয়া মাছের জননাঙ্গ কিছুটা স্ফীত এবং ডিম ধারণ করার কারণে পেটের দিক যথেষ্ট ফোলা থাকে। পুরুষ কুচিয়া মাছ স্ত্রী কুচিয়া মাছের তুলনায় আকারে ছোট হয়ে থাকে। প্রকৃতিতে ২০০-৪০০ গ্রাম ওজনের কুচিয়া মাছ পরিপক্ক হয়ে থাকে এবং গড়ে ২৫০-৬৫০টি ডিম ধারণ করে।
কুচিয়া মাছের ডিম কমলা বর্ণের ও আঠালো হয়, অর্থাৎ একটির সঙ্গে অপরটি ভুট্টার দানার মত লেগে থাকে। কুচিয়ার ডিম একসাথে পরিপক্ক হয় না বলে একবারে সব ডিম ছেড়ে দেয় না। এরা নিজেদের তৈরী গর্তে ডিম দেয় এবং সেখানেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
কুচিয়া মাছের পুকুর প্রস্তুতকরণ : যেহেতু কুচিয়া মাটির অনেক নীচ পর্যন্ত গর্ত করে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরে চলে যায় সেহেতু নির্ধারিত পুকুরে কুচিয়াকে রাখার জন্য পুকুরের তলদেশ এবং পাড় পাকা করলে ভালো। গ্লাস নাইলনের নেট বা রেক্সিন বা মোটা পলিথিনের উপর কমপক্ষে ২-৩ ফিট মাটি দিতে হবে। পুকুরের একপাশে কম্পোস্টের স্তুপ অথবা সারা পুকুরে ১ ইঞ্চি পরিমান কম্পোস্ট দিতে হবে। পুকুরে পর্যাপ্ত পরিমানে কচুরীপানা থাকতে হবে, বিশেষ করে প্রজনন মৌসুমে পুকুরের ৩/৪ ভাগের বেশী পরিমানে কচুরীপানা থাকতে হবে।
কুচিয়া মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা : প্রাকৃতিক উৎস থেকে সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত কুচিয়া সংগ্রহ করে তিন মাস পুকুরে পরিচর্যার মাধ্যমে ব্র“ড কুচিয়া তৈরি করা হয়। সংগৃহিত ব্র“ড কুচিয়াকে নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো জন্য হ্যাচারিতে বা পুকুরে হাপায় রেখে ৫-৭ দিন পরিচর্য়া করতে হবে। এছাড়া সংগ্রহকারীরা দীর্ঘদিন অধিক ঘনত্বে চৌবাচ্চায় বা ড্রামে মজুদ রাখে বিধায় পেটের নিচের দিকে ঝোপ ঝোপ রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থায় থাকে। সুস্থ সবল ব্র“ড কুচিয়ার পুরুষ এবং স্ত্রী সনাক্ত করার পর ১৫০-২৫০ গ্রাম ওজনের পুরুষ কুচিয়া এবং ২৫০-৩৫০ গ্রাম ওজনের স্ত্রী কুচিয়া মাছকে প্রস্তুতকৃত পুকুরে ১ঃ২ অনুপাতে শতাংশে ৩০ টি করে মজুদ করতে হবে।
কুচিয়ার পোনা সংগ্রহ পদ্ধতি : প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী হলে মে-জুন মাসের মধ্যে ব্র“ড প্রতিপালন পুকুর থেকে পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব। পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে প্রাথমিকভাবে গ্লাস নাইলনের তৈরি হাপার মাধ্যমে কচুরীপানা সংগ্রহ করে পুকুর পাড়ে বা সমতল স্থানে উঠিয়ে আনতে হবে। এ সময় ১৫-২০ মিনিটের জন্য হাপার মুখ হালকাভাবে বেঁধে রাখতে হবে। অতপর হাপার বাঁধন খুলে আলতোভাবে উপর থেকে কচুরিপানা ঝেড়ে ঝেড়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। ইতোমধ্যে জমা হওয়া পোনাগুলোকে সংগ্রহ করে প্রাথমিকভাবে হ্যাচারিতে বা পুকুরে পূর্ব থেকে স্থাপিত গ্লাস নাইলনের হাপায় মজুদ করতে হবে।
পোনা লালন-পালন : কুচিয়ার মাছের পোনা স্টীলের ট্রে বা সিমেন্টের চৌবাচ্চায় লালন-পালন করা যায়। ট্রে বা চৌবাচ্চা আয়তাকার কিংবা বর্গাকার হতে পারে। সাধারণত মাছের ক্ষেত্রে ৩টি অর্থাৎ রেণু পোনা, ধানী পোনা এবং অঙ্গুলি পোনা পর্যায়ে পৃথক পৃথক ভাবে পরিচর্যা করা হয়ে থাকে। কুচিয়া মাছ স্বপ্রজাতিভোগী তাই প্রতিটি ধাপে স্বাস্থ্য পরীক্ষাকালীন সময়ে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং দুর্বল পোনাগুলোকে আলাদা করতে হবে।
১ম ধাপ : ডিম্বথলি নি:শেষিত হওয়া কুচিয়া পোনাকে বেবি কুচিয়া বা গ্লাস ঈল বলা হয়। বেবি কুচিয়ার গায়ের রং গাঢ় বাদামী বা কালো বর্ণের হয়। এই পর্যায়ের পোনা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গ মিটারে ৪০০-৫০০টি কুচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। বেবি কুচিয়া মজুদের পর পর্যাপ্ত পরিমানে জুপ্লাংটন সরবরাহ করতে হবে।
২য় ধাপ : সাধারনত: ১০-১৫টি কুচিয়ার পোনার ওজন ১ গ্রাম হলে এই পর্যায়ের অর্ন্তভূক্ত হবে। এই ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫০-২০০টি কুচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। এই পর্যায়ে পোনাকে জীবিত টিউবিফেক্স সরবরাহ করতে হবে।
৩য় ধাপ : সাধারনত: ৪-৫ গ্রাম ওজনের পোনা এই পর্যায়ের অর্ন্তভূক্ত হবে। এই ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৭৫-১০০টি কুচিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। এই পর্যায়ে খাদ্য হিসেবে জলজ পোকা (হাঁস পোকা) জীবিত বা মৃত অবস্থায় সরবরাহ করা যেতে পারে। পাশাপশি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে পোনার দেহ ওজনের ১০-১৫% পর্যন্ত মাছের কিমা সন্ধ্যার পর সরবরাহ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।
ট্রেতে পোনা পালন : ট্রেতে পোনা নাসিং করলে ব্যবস্থাপনায় সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে ট্রের আকার দৈর্ঘ্য ১.২৫ মি., প্রস্থ ০.৭৫ মি. এবং গভীরতা ০.১৫ মি. হলে ভাল। গবেষণা প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা যায় কুচিয়ার পোনা নাসিং ৪৫-৬০ দিন হলে ভাল হয়। ট্রেতে নাসিং করার আগে ট্রের মধ্যে মাটির স্তর (৪-৫ ইঞ্চি), পানি ও কচুরীপানা দিয়ে পোনার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে নিতে হবে। ট্রের মধ্যে পানির গভীরতা হবে ০.২৫ ফুট।
সিমেন্টের চৌবাচ্চায় পোনা পালন : আয়তাকার সিমেন্টের চৌবাচ্চায় (দৈর্ঘ ২.৫ মি., প্রস্থ ১.৫ মি.ও গভীরতা ০.৭৫ মি.) কুচিয়ার পোনা নাসিং করা সুবিধাজনক। চৌবাচ্চায় নাসিং করার ক্ষেত্রে ট্রের মতো কাদা মাটির ¯তর (৫-৬ ইঞ্চি), পানি ও কচুরীপানা দিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে নিতে হবে। চৌবাচ্চায় পানির গভীরতা হবে ০.৪ ফুট।
কুচিয়া পালনে পরামর্শ :
- ট্রে কিংবা চৌবাচ্চায় পোনা প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কচুরিপানা অল্প পরিমাণে দিতে হবে।
- কুচিয়া মাছের পুকুরে জোঁকের আক্রমণ যাতে না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
- কচুরিপানার পরিমাণ বেশি হলে নাইট্রোজেনের আধিক্যের কারণে পোনার মৃত্যুহার বেড়ে যেতে পারে।
- প্রজননের জন্য ব্যবহৃত পুকুর ও চৌবাচ্চার মাটি অবশ্যই এটেল-দোঁআশ হতে হবে।