
প্রভাষ আমিন :
কঠোর লকডাউনে অনেকের অনেক অসুবিধা হলেও আমার একটু সুবিধাই হয়েছিল। মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ান বাজারে আমার অফিস যেতে মিনিট দশেক লাগত। শেষদিকে সময় একটু বেশি লাগছিল। তবে সোমবার রাস্তায় নেমে আমি রীতিমত ভড়কে যাই। কাগজে-কলমে কঠোর বিধিনিষেধ বা কঠোর লকডাউন থাকলেও রাস্তা দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। গণপরিবহন নেই, তাতেই রাস্তায় বাম্পার টু বাম্পার জ্যাম। আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, লকডাউন তো ১০ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকার কথা, ১১ আগস্ট থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু খুলে দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে রবিবার সন্ধ্যায়।
মানুষ কি সেই প্রজ্ঞাপনকেই নিজ দায়িত্বে এগিয়ে নিল, নাকি আমার বোঝার কোনো ভুল হচ্ছে। আবার চেক করে দেখলাম। কাগজে-কলমে মঙ্গলবার পর্যন্ত লকডাউন থাকবে, বুধবার থেকে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার কথা। বুঝলাম—কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কঠোর বিধিনিষেধ প্রজ্ঞাপনে থাকলেও রাজপথে নেই। একটা বিষয় পরিষ্কার, ঘনবসতির বাংলাদেশে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া লকডাউন কার্যকর করা সত্যি কঠিন। হিসাবটা কিন্তু সোজা—দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে ৯৯ ভাগ মানুষ লকডাউন মানলেও দুই লাখ লোক রাস্তায় থাকবে। লকডাউনের শেষ দিকে এসে এখন মনে হয় অর্ধেক মানুষই রাস্তায়। সরকার আসলে উভয় সঙ্কটে আছে। লকডাউন না থাকলে করোনার সংক্রমণ বাড়বে, আর লকডাউন কার্যকর করতে গেলে টান পড়বে জীবিকায়।
করোনা সংক্রমণের যে অবস্থা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথা মানলে দেশে টানা কড়া লকডাউনে থাকার কথা। আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির যে অবস্থা, টানা লকডাউনের ধকল সামলানোর সক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষ আছে, ঘর থেকে না বের হলে যাদের চুলা জ্বলবে না। করোনার ভয় না ক্ষুধার ভয়; সামনে যখন এই প্রশ্ন, তখন মানুষ বেপরোয়া হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘর থেকে বের হলেই তো টাকা পাবে না, কাজ করতে হবে। কিন্তু লকডাউনে কাজ পাবে কোথায়? যারা বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়ে নামেন, তারা যাত্রী পান না।দিনমজুররা দিনভর বসে থেকেও কাজ পান না। এমনকি ভিক্ষা দেওয়ার মতো লোকও থাকে না রাস্তায়। তাই বারবার লকডাউন অকার্যকর হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রয়োজনে আবার লকডাউন দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি যতই হুমকি দেন, বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব। আর গত কয়েকদিনে দফায় দফায় লকডাউনের নামে যে হাস্যকর ছেলেখেলা হয়েছে, তাতে মানুষ আর লকডাউনের ঘোষণাকে বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।
তাহলে কি আমরা অনিবার্য মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করব? আমরা যদি সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, তাহলেও করোনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ব্যক্তিগত সুরক্ষাটাই জরুরি। সবাইকে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। এটুকু মেনে চললেই আর লকডাউন লাগবে না। কিন্তু আমরা সবাই বিপ্লবী।সরকারের নির্দেশনা ভাঙ্গতে পারার মধ্যেই যেন আমাদের আনন্দ। সরকার যা বলবে, আমরা করব তার উল্টোটা। লকডাউনের সময় কত মানুষ অকারণে বাইরে ঘোরাঘুরি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। আর্মি বা পুলিশের ভয়ে বড় রাস্তায় যেতে না পারলেও পাড়া বা গলির রাস্তা ছিল জনবহুল।
আমরা আর্মি বা পুলিশকে, জেল বা জরিমানাকে ভয় পেলেও মৃত্যুকে একদম ভয় পাই না। সবাই যেন মৃত্যুঞ্জয়ী। কিন্তু প্রতিদিন কম বেশি আড়াইশ মানুষের মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেললেও মৃত্যু থেকে বাঁচার উপায় নেই। কঠোর হোক আর ঢিলেঢালা, সরকার লকডাউন দেয় কিন্তু আপনার আমার জীবন বাঁচানোর জন্য। আমরা যদি সাবধান না হই, সরকারের সাধ্য নেই আমাদের বাঁচায়।বাংলাদেশের অবস্থা টানাটানির সংসারের মতো। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। পা ঢাকতে গেলে মাথা উদোম হয়ে যায়। করোনা থেকে বাঁচার শেষ উপায় হলো—টিকা। দেশের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পারলেই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। সেই হিসাবে, ১৪ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা সহজ কথা নয়।
প্রথম কথা হলো, ১৪ কোটি মানুষের জন্য ২৮ কোটি ডোজ টিকা লাগবে। টিকা নিয়ে যে বৈশ্বিক রাজনীতি চলছে, তাতে ২৮ কোটি টিকা জোগাড় করা দুরূহ। তবু সরকার নানা উৎস থেকে ২১ কোটি টিকার আশ্বাস পেয়েছে। কিন্তু টিকা হাতে থাকলেও ১৪ কোটি মানুষকে তা দেওয়াও এক বিশাল যজ্ঞ। বাংলাদেশের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দারুণভাবে। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে টিকা কিনতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু ভারতে করোনা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে আগাম অর্থ দেওয়া থাকলেও টিকা পাওয়া যায়নি। পরে অবশ্য অন্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, যত টাকাই লাগুক, সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা হবে। পাশের দেশ ভারতেও যেখানে টিকা নিতে অর্থ লাগে, সেখানে বাংলাদেশে একদম বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে সরকার। শুরুর দিকে ভারত থেকে টিকা আনা নিয়ে নানা অপপ্রচার হয়েছে, রাজনীতি হয়েছে। ফলে শুরুতে টিকা কার্যক্রম গতি পায়নি। সরকার নানা প্রচার-প্রচারণা চালিয়েও মানুষকে আগ্রহী করতে পারেননি। টিকার আওতা বাড়াতে বয়স সীমা কমিয়ে ২৫ করা হয়েছে।গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে গণটিকা কার্যক্রম। এবার দেখা যাচ্ছে, মানুষ বিপুল আগ্রহ নিয়ে টিকা কেন্দ্রে আসছে। দেশে ভোটের লাইন স্মৃতি হয়ে গেছে অনেক আগেই। টিকার লাইন সেই লাইনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। টিকা নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তার সমান্তরালে ছিল না সরকারের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা। প্রথম দুদিনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি টিকা দেওয়া হলেও গণটিকা কার্যক্রম পরিণত হয়েছে গণভোগান্তিতে।
অধিকাংশ টিকা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। ভিড়, চিৎকার, হুল্লোড়ে করোনার পালানোর দশা। অনেকে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও টিকা পাননি। শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক কেন্দ্রে টিকা ফুরিয়ে গেছে। ব্যাপক বিশৃঙ্খলা আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগ গণটিকার সাফল্যকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামের এক এমপি তার এলাকায় নিয়মকানুন না মেনে অন্তত দুই হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। আগেই বলেছি, টিকাই হলো আমাদের শেষ ভরসা। প্রতিশ্রুত ২১ কোটি টিকা পাওয়া গেলে জনসংখ্যার বড় অংশকেই টিকার আওতায় আনা যাবে। তবে মাথায় রাখতে হবে, টিকা ব্যবস্থাপনাটা যেন ভালো হয়। এমনিতে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। শেখ হাসিনা পেয়েছেন ভ্যাকসিন হিরো’র সম্মান। করোনার টিকাদান কার্যক্রমেও যেন সেই সুনাম আর সম্মান অক্ষুণ্ন থাকে।বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি হয়েছে নদীর মতো—এপার ভাঙে ওপাড় গড়ে। জীবন বাঁচাতে লকডাউন দিলে জীবিকা বাঁচে না। আবার টিকা দিতে গেলেও পড়তে হয় নানান ভোগান্তিতে। মানুষ যাবে কোথায়? এখনই পুরোপুরি সুস্থতা নিশ্চিত করতে না পারলেও স্বস্তিটা যেন পায় মানুষ।
প্রভাষ আমিন : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।