
প্রভাষ আমিন : বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বড় শক্তি বিএনপি। এদেশের রাজনীতি আসলে দ্বি-দলীয়। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি। ১৯৭৫ সালের নানা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। সামরিক শাসক হিসেবে ক্যান্টনমেন্টে থেকেই দেশ শাসন করতেন তিনি। সেই বিএনপি ক্ষমতায় ছিল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিএনপির রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা নেন এরশাদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন গৃহবধূ বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক নেত্রীতে পরিণত করে। ক্যান্টনমেন্টে বানানো দলকে গণতান্ত্রিক করে তোলেন বেগম জিয়া।
এরশাদ পতনের পর জনরায় নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে পূর্ণ মেয়াদে দুই দফা, স্বল্প মেয়াদে এক দফা—মোট তিন দফা ক্ষমতায় ছিল দলটি। কিন্তু এমন দাপুটে বিএনপি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন যাদের বয়স ২০, তাদের স্মৃতিতেও ক্ষমতাসীন বিএনপি নেই। কারণ ২০০৬ সালের পর বিএনপি আর ক্ষমতার স্বাদ পায়নি।
শুরুতে বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বি-দলীয় ধারায় চলমান বলা হলেও, সেটাও এখন অতীতকাল। বিএনপি এখন কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সমান্তরাল রাজনৈতিক শক্তি নয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ড ভোগ করছেন।
সরকারের অণুকম্পায় কারাগারের বদলে বাসায় থাকতে পারছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে আছেন। বিএনপি এখন নেতৃত্বহীন, উদ্দেশ্যহীন এক রাজনীতিক দল। সংসদে যাদের আসন মাত্র ৬টি। দলটি রাজপথে নেই, সংসদে নেই। কালেভদ্রে ব্রিফিং ছাড়া তাদের আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না।
গত এক যুগে আওয়ামী লীগ সরকার দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা, গুম-খুনে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে দলটিকে। সরকারের নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার কাছে কোনোভাবেই টিকতে পারছে না দলটি।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথ থেকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির নবযাত্রা শুরু হলেও এখন তারা যেন আন্দোলনও ভুলতে বসেছে। বিএনপির এই পরিণতির জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী। তবে আমি মনে করি, বিএনপির আজকের পরিণতি তাদের পাপের ফসল। এই পাপটা তারা করেছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। সরকার হটাতে নানান কৌশলও নেয় বিরোধী দল। কিন্তু বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে সরকারি দল রাষ্ট্র যন্ত্রের সহায়তায় গ্রেনেড হামলা চালাতে পারে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। সেই অবিশ্বাস্য কাজটিই করেছিল বিএনপি। সেই পাপ আজ তাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আসলে একটি ধারাবাহিকতার অংশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় সেদিন বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যেন ছিল ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার মিশন। এই ১৫ আগস্ট আর ২১ আগস্ট তারিখ দুটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বিএনপির মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয় বিভেদ রেখা টেনে দিয়েছে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বিএনপির জন্মই হয়নি। জিয়াউর রহমান তখন উপ সেনাপ্রধান। ঘটনাক্রমে তিনিই ১৫ আগস্টের মূল সুবিধাভোগী। ’৭৫-এর খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দারুণ ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল তার সামনে। কিন্তু উল্টো তিনি খুনি মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রেখে এবং খুনিদের পুরস্কৃত করে ১৫ আগস্টের দায় অনেকটাই নিজের কাঁধে টেনে নেন। আর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৫ আগস্ট নিজের জন্মদিন আবিষ্কার করেন এবং তা ঘটা করে পালন করে আওয়ামী লীগের বেদনাকে আরও বাড়িয়ে তোলেন।
গত কয়েকবছর খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন পালন করা হয় না। এটা এক ধরনের নীরব প্রায়শ্চিত্ত। কিন্তু ২১ আগস্টের প্রায়শ্চিত্তটা এখনো করেনি বিএনপি। আদালতে প্রমাণিত হয়েছে ২১ আগস্টের ষড়যন্ত্র হয়েছে হাওয়া ভবনে, তারেক রহমান সরাসরি জড়িত, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপির মন্ত্রিসভার অন্তত দুজন সদস্য এ ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।
ঘটনা প্রবাহে বিশ্বাস করার কারণ জন্মে যে, আগে না হলেও ঘটনার পর বেগম খালেদা জিয়াও ঘটনা জানতেন এবং তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করায় তার দায় আছে। বিএনপি যতদিন এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত না করবে, ততদিন তাদের রাজনীতিতে ফেরা কঠিনই হবে।
বিএনপির ওপর আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নে, মামলা-হামলার অনেক সমালোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দলের কাছ থেকে এমন স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ অনাকাঙ্ক্ষিত। মনে হতে পারে, বিএনপির ব্যাপারে শেখ হাসিনা একটু বেশিই নিষ্ঠুর। কিন্তু আপনি যখন শেখ হাসিনার অবস্থান থেকে ভাববেন, তখন তাকে অত নিষ্ঠুর মনে নাও হতে পারে। যারা তাকে গ্রেনেড মেরে হত্যা করতে চেয়েছে, তিনি তাদের প্রতি সদয় থাকবেন না, এটা স্বাভাবিক। তিনি যদি পাল্টা গ্রেনেড মারতেন, তাহলে তাকে প্রতিশোধপরায়ণ বলা যেতে। আদতে তা না।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করেছে ওয়ান-ইলাভেন সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার তা এগিয়ে নিয়েছে এবং আদালতের রায়ে কারাগারে গেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আর তারেক রহমান পালিয়ে আছেন। একজন গ্রেনেড মেরে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেন, আরেকজন আইনি ও রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছেন।
বিএনপিকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে, অতীতে অপকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে হবে, অপরাধের জন্য সাজা ভোগ করতে হবে। বিএনপি যদি অপরাধ ভুলে নতুন করে শুরু করতে চায়, তাহলেই কেবল আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাঝখানের দেয়ালটি লঙ্ঘন করা যাবে। নইলে তা অলঙ্ঘনীয়ই থেকে যাবে।
২১ আগস্ট হয়ে থাকবে আমাদের রাজনীতির স্থায়ী বিভক্তি রেখা, টার্নিং পয়েন্ট।
লেখক : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।