
কামাল আহমেদ :
কূটনীতির অংশ হিসেবে আমকে কাজে লাগানো সব সময় সহজ নয়। কলম্বো টেলিগ্রাফ-এ রাঙ্গা কালানসুরিয়ার এক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে শ্রীলঙ্কায় শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছে যে আম পাঠিয়েছিলেন, তিনি তা ফেরত দিয়েছিলেন। পত্রিকাটি চিঠির যে ভাষ্য উদ্ধৃত করেছে, তাতে লেখা হয়েছে, পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর রক্ত যে ব্যক্তির হাতে লেগে আছে, তাঁর কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত। ফাঁসিতে ঝোলানোর কারণে শ্রীমাভো ওই আমের চালান ফেরত দেন এবং শেষ পর্যন্ত কলম্বোয় পাকিস্তান দূতাবাসের কূটনীতিকদের সেগুলো হজম করতে হয়েছিল।
উপমহাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বজুড়ে। এ কারণে উপহার হিসেবে আমের ব্যবহারও পুরোনো। ভারতবর্ষে মোগল আমল থেকে এই আমের সঙ্গে ক্ষমতা, কূটনীতি ও আনুগত্যের যোগসূত্রের নানা নজির রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেবের বিরোধ। দাক্ষিণাত্যের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের দরবারে আম না পাঠানোর কারণে তাঁকে বন্দী করেছিলেন। পরে আওরঙ্গজেব যখন মসনদ দখল করেন, তখন পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাসের সমর্থন আদায়ের জন্য তাঁকে উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছিলেন। আম কূটনীতির সূচনা সম্ভবত তখন থেকেই।
বিপরীতে পাকিস্তান মাও সে তুংয়ের জন্য আম পাঠিয়েই থেমে যায়নি, দেশটির সরকারপ্রধানেরা ধারাবাহিকভাবে আম কূটনীতি চালিয়ে আসছেন। ভুট্টো ১৯৭২ সালেই ইন্দিরা গান্ধীকে আম পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মি. কালানসুরিয়া। তবে গোল বাধে ১৯৮১ সালে যখন জেনারেল জিয়াউল হক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট সঞ্জীব রেড্ডিকে আম পাঠান। আমের সঙ্গে পাঠানো বার্তায় তিনি জানিয়েছিলেন যে এটি তাঁর দেশের সেরা আম। ‘রাতাউল’ নামের ওই আমের প্রশংসা করে স্বদেশে বিপত্তির মুখে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। রাতাউল নামের ওই আম পাকিস্তানের নিজস্ব কোনো জাত নয় বলে প্রতিবাদ জানান ভারতের রাতাউল জেলার আমচাষিরা। তাঁরা দাবি করেন, দেশভাগের সময়ে রাতাউল থেকেই আমগাছের কিছু চারা নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানে ওই জাতের চাষ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রাতাউল আম দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিরোধের জন্ম দেয়।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে যখন সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী ও সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে এবং ড্রোন ভূপাতিত করা নিয়েও চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ, তখন নওয়াজ শরিফও ভারতের নেতাদের জন্য আম উপহার পাঠিয়েছিলেন। তিনি পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও কংগ্রেস দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধীর জন্য। এর আগে জেনারেল পারভেজ মোশাররফও প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির জন্য আম পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেবারও তাঁর দিল্লি সফরে কোনো সুফল আসেনি।
আম এবং আম কূটনীতি নিয়ে উপমহাদেশের এসব চমকপ্রদ কাহিনির কোনোটিতেই অবশ্য কূটনৈতিক কোনো সাফল্যের প্রমাণ মেলে না। হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সুসময়েও যেসব বিরোধ বজায় আছে, সেগুলোর কথাও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে চলমান কোভিড মহামারি মোকাবিলায় টিকার চুক্তিমতো প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার কথা। ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ রাখায় প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন ১৫ লাখ মানুষ। এ কারণে অস্বস্তি বাড়ছে এবং বাংলাদেশ টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধানে চীন, রাশিয়াসহ নানা দেশের শরণাপন্ন হচ্ছে।
অস্বস্তি যে শুধু টিকার জন্য, তা-ই নয়; যেদিন রংপুরের আম উপহারের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেদিনই রংপুর তিস্তার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ছবি নানা নিউজ পোর্টালে প্রকাশ পেয়েছে। রংপুরের এই দুঃখের উৎস যে নদী, সেই তিস্তার আলোচনা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুধুই বাড়ছে। ইলিশ পাঠিয়েও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মন গলানো যায়নি।
জানিয়ে রাখা ভালো, আম কূটনীতি নিয়ে অবশ্য এবারও বিপত্তি বেধেছে এবং তা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই। গত জুন মাসে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বড় শিরোনাম হয় যে পাকিস্তানের পাঠানো উপহারের আম ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কয়েকটি দেশ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি গত মাসের শুরুতে ৩২টি দেশে আম পাঠানোর উদ্যোগ নেন। গত ১৩ জুন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসব খবর তথ্যভিত্তিক নয় এবং বিভ্রান্তিকর বলে বিবৃতি দেয়। স্পষ্টতই পাকিস্তানের আম কূটনীতি গত কয়েক দশকে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের আম কূটনীতিতে কি ব্যতিক্রম কিছু মিলবে?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
(প্রকাশিত লেখাটির মতামত লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে কোন আইনগত ও অন্য কোন ধরনের দায়-ভার মিরর টাইমস্ বিডি বহন করবে না)।