
আবির সরকার, ঢাকা : ক্যাসিনো-কাণ্ডসহ গত কয়েক বছরের নানা আলোচিত ঘটনা ও মামলায় বেশ কয়েকজন কারাবন্দি এখনো কারাগারের বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে অভিযোগ আছে তারা আসলে ‘আরাম আয়েসে’ থাকার জন্যই নানা ছুতোয় হাসাপাতালে আছেন। এদের মধ্যে জি কে শামীম, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও ডেসটিনির রফিকুল আমীনসহ আরো অনেকেই আছেন। এদের মধ্যে হাসপাতালের কেবিনে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে জুম বৈঠক করেছিলেন রফিকুল আমীন। এ কারণে গত ৩ জুলাই কারাগারে ফেরত পাঠানো হয় তাকে। তবে জি কে শামীম বিএসএমএমইউ এর প্রিজন সেলে, এবং সম্রাটের অবস্থার অবনতি হলে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ)। কারাগারে থাকা এসব ‘ভিআইপি’ আসামিরা সেখানে বসেই আইনের বাইরে নানা সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কারা অধিদপ্তরের সর্বশেষ মাসিক প্রতিবেদন বলছে, শুধু সম্রাট, জি কে শামীমরা একা নন, সারা বছরই শতাধিক আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত বন্দী চিকিৎসার জন্য কারাগারের বাইরে হাসপাতালে থাকেন। এর মধ্যে কেউ কেউ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টানা হাসপাতালে থাকছেন। ক্যাসিনো-কাণ্ড আর শুদ্ধি অভিযানে আটক যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট তাদের অন্যতম। তিনি প্রায় দের বছর ধরে হাসপাতালে হাসপাতালে রয়েছেন।
কারাসূত্রে জানা গেছে, শুধু রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৭ কারাবন্দি। এদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিন জন, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে দুই জন, পঙ্গু হাসপাতালে এক জন, হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে পাঁচ জন, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে সাত জন এবং সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছয় জন কারাবন্দি চিকিৎসাধীন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বন্দিদের মধ্যে আছেন ভারতীয় নারী উর্মিলা। কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে ৪ জুলাই তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। আর কারাগারে থাকা অন্য ‘ভিআইপি’ আসামিরা সেখানে বসেই আইনের বাইরে নানা সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন হাসপাতালের কেবিনে বসে ইন্টারনেট ব্যবহার করে জুম বৈঠক করেছিলেন। এ কারণে গত ৩ জুলাই কারাগারে ফেরত পাঠানো হয় তাকে। মূলত এ ঘটনার পরই বন্দিদের দীর্ঘ ‘চিকিৎসা’ নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন। নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় কারা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
এ ঘটনায় প্রিজন সেলে রফিকুল আমীনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান কারারক্ষীসহ ৮ জনকে ইতিমধ্যে প্রত্যাহার (ক্লোজড) করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে চার জন ডেপুটি জেলারকে সতর্ক করার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ১৩ জন্য কারারক্ষীর বিরুদ্ধে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কারারক্ষীদের সবাই কিছুই না বলে নিজেদের দোষ অস্বীকার করেছেন এবং একই জবানবন্দি দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি জানতে পেরেছে, বিশ্বনাথ পোদ্দার নামে একজন ব্যক্তি নিয়মিত প্রিজন সেলে আসতেন। তাঁর পরিচয়ের বিষয়ে রফিকুল আমীন জানিয়েছেন, তিনি তাঁর সেবক ছিলেন। ওষুধপথ্য ও বাজার করে দিতেন এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন।
ক্যাসিনো ও মানি লন্ডারিংসহ একাধিক মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি আছেন জি কে শামীম ও সম্রাট। কারাবন্দি থাকলেও তারা বিভিন্ন সময় বিএসএমএমইউ ও বারডেমসহ কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তাদের ‘চিকিৎসা’ চলছে মাসের পর মাস।
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে বিএসএমএমইউ’র প্রিজন সেলে আছেন সম্রাট। তার হার্টে সংক্রমণের কথা জানা গেছে।
২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নিকেতনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীম। অস্ত্র ও মাদক মামলার এই আসামিকে ‘ডান হাতের ক্ষতস্থান থেকে প্লেট সরানো’র জন্য কারাগার থেকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে দুই দিনের মধ্যে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর কথা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাসে দুই দফা চিঠি দিলেও তাঁকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়নি।
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন ‘বুকে ব্যথা’র ছুতোয় হাসপাতালের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে দিন যাপন করছেন শামীম। পরিচিতজনদের সঙ্গে তাঁর দেখা সাক্ষাৎ চলছে নিয়মিত। তাকে ফেরত চেয়ে সর্বশেষ জুলাই মাসেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। তার এক হাতে মেডিক্যাল ডিভাইস লাগানো রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যার কথা বলে প্রায়ই হাসপাতালের প্রিজন সেলে গিয়েছেন তিনি।
এছাড়াও এ হাসপাতালে আজগর আলী নামের আরেক বন্দি আছেন যিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ১৫ এপ্রিল থেকে ভর্তি আছেন তিনি।
অভিযোগ উঠেছে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশ কান্ডে গ্রেপ্তার সাজিন এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহাদত হোসেনসহ তার সহযোগীরা কারাগারে বসেই বাইরে তাদের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহাবুবুল ইসলাম মিরর টাইমসকে বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কারাবন্দিদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু ছাড়পত্র দিয়ে ফেরত পাঠানোর দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আমরা প্রতি ১৫ দিন পর আসামিদের ফেরত পাঠানোর তাগাদা দিয়ে চিঠি পাঠাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন ফেরত পাঠাচ্ছে না, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
জেলার বলেন, রোগী কেমন আছেন, সেটা চিকিৎসক ভালো বুঝবেন। আমাদের দায়িত্ব তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো হলে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন বারবার চিঠি পাঠালেও রেসপন্স করছে না সেটা তারাই জানেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বন্দিকে সুস্থ মনে করলে কারাগারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল সরকারের। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। এটার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সম্পর্ক নেই।
ভিসি আরো বলেন, চিকিৎসা হয়ে গেলে কারাগারে ফেরত না পাঠানো অপরাধ। তবে এরা কে কখন আসছে, কখন যাচ্ছে, তা আমার নলেজে নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক মিরর টাইমসকে বলেন, কারাবিধি ও আইনের অনেক বড় ধারা। এতো কিছু বলা সম্ভব না। তবে আইন অনুযায়ী যেসব ব্যবস্থা আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে এসব বন্ধ হবে।
ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানে ঢাকাসহ সারাদেশে ৩০টির বেশি মামলা হয়৷ গ্রেপ্তার হয় একশ’র বেশি। ওই মামলাসহ পরের আলোচিত ঘটনা ও মামলাগুলো ব়্যাব, সিআইডি, ডিবি, থানা পুলিশ ও দুদক তদন্ত করছে। গত বছরের জানুয়ারিতে জিকে শামীমের অস্ত্র মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা করোনার কারণে থমকে যায়। করোনার কারণে ভার্চুয়াল তবে আদালত খুলে গেছে। স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি মো. সোহেল রানা বলেন, বেশিরভাগ মামলায়ই এরই মধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তবে করোনা কারণে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।